রাজধানী গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের বাসার তৃতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল ১৩ বছর বয়সী শান্তা (ছদ্মনাম)। হঠাৎ সে এক শিশুর আর্তনাদ শুনতে পায়। শিশুটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বারবার বলছিল- ‘মার কাছে যাব।’ শান্তা দ্রুত বাসার ভেতরে ঢুকে দেখতে পায়, প্রতিবেশী দুই বছরের আয়শাকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে তার বাবা নাহিদ হোসেন। কী করা উচিত বুঝতে না পেরে সে ঘরের দরজা থেকে সরে যায়। একটু পরই নাহিদ বারান্দা থেকে শিশুটিকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে।
গতকাল মঙ্গলবার সে আদালতে নিজের বাবার অপকর্মের এমন বর্ণনা দেয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার নাহিদকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এদিকে বুকের ধন হারানোর শোকে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছেন শিশুটির বাবা-মা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী কমিশনার সামসুজ্জামান বাবু সমকালকে বলেন, ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে শান্তা। তার বর্ণনা ও পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে নাহিদের অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। সুস্থ হলে নাহিদকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে সাধনা ঔষধালয় গলির ৮২/সি-২ নম্বর টিনশেড বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকত ছোট্ট আয়শা। গত শনিবার বিকেলে বাসা থেকে বের হওয়ার পর সন্ধ্যায় পাশের একটি ভবনের সামনে তার রক্তাক্ত নিথর দেহ পাওয়া যায়। স্বজনদের অভিযোগ, শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। অভিযুক্ত নাহিদের শাস্তির দাবিতে সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ করেন স্বজন ও এলাকাবাসী।
তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়ে শনিবার রাতে পুলিশ নাহিদের বাসায় যায়। তবে ওই সময় তাকে পাওয়া যায়নি। সে গ্রেফতার এড়াতে চারতলার ছাদে উঠে পাইপ বেয়ে পাশের ভবনের ছাদ দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রাথমিক তদন্তে তার অপরাধ সংশ্নিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার পর রোববার রাতে আবার অভিযান চালায় পুলিশ। এবারও নাহিদ ছাদে উঠে একই কায়দায় পালানোর চেষ্টা করে। দুই-তিনটি বাড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পর পাইপ বেয়ে নামার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ভবন থেকে পড়ে দুই পায়ে গুরুতর আঘাত পায় নাহিদ। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যার কথা স্বীকার করেনি। তার দাবি, ঘটনার সময় সে নিজের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন শিশুটির পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলেও কীভাবে সে পড়ে যায় তার জানা নেই।
আয়শার বাবা ইদ্রিস আলী জানান, নাহিদকে গ্রেফতারের সময়ই পুলিশ শান্তাকে উদ্ধার করে। তাকে একটি ঘরে আটকে রেখেছিল নাহিদ। বঁটি দিয়ে ভয় দেখিয়ে চুপচাপ থাকতেও বলেছিল। রোববার মুক্ত হওয়ার পর সে সবার সামনেই তার বাবার পাশবিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে। পরে গতকাল আদালতেও সাক্ষ্য দেয়।
আয়শার মামা মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ, শনিবার বিকেলে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলে আয়শাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় নাহিদ। সেখানে ধর্ষণের পর সে শিশুটিকে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দেয়। ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েক যুবক নাহিদকে আটকে এ ব্যাপারে জানতে চান। তবে নাহিদ দাবি করে, সে কিছুই জানে না।
স্থানীয়রা জানান, নাহিদের প্রথম স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।
কবর খুঁড়ে লাশ বের করার চেষ্টা মায়ের :বুকের ধন হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছেন আয়শার মা রাজিয়া সুলতানা। কাঁদতে কাঁদতে একটু পরপরই তিনি অচেতন হয়ে পড়ছেন। গতকাল ভোরে তিনি চলে যান জুরাইন কবরস্থানে। সেখানে কবর খুঁড়ে তিনি মেয়ের লাশ বের করার চেষ্টা চালান। পরে স্বজন ও উপস্থিত লোকজন তাকে সরিয়ে নেন। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ইদ্রিস আলীও বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
রাজিয়া সুলতানা পেশায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী। তার স্বামী ইদ্রিস আলী ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। তাদের চার মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল আয়শা। পরের দুটি সন্তান যমজ। অভাব-অনটনের মধ্যেও চার সন্তানকে নিয়ে ছিল তাদের সুখের সংসার। আয়শার মৃত্যুতে এখন সেখানে শুধুই কান্না আর হাহাকার।